মেহারন দালাল বাড়ি। নাম শুনলে মনে হবে একটি বাড়ি মাত্র। কিন্তু দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত একটি গ্রাম নিয়েই যদি হয় একটি বাড়ি। আর যদি সেই বাড়িতে একত্রে বসবাস করে ৩৬০টি পরিবারের প্রায় সাত হাজার মানুষ। তবুও নেই কোনো মারামারি হানাহানি।
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার ২নং নায়েরগাঁও ইউনিয়নের মেহারন দালাল বাড়ি। ঘনবসতিপূর্ণ এই বাড়ির সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী। বাসিন্দারা পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। এ বাড়িতে ভোটার প্রায় ৩ হাজার। বাড়ির বাসিন্দারাই নিজেদের মধ্যে নির্বাচিত করেন একজন ওয়ার্ড মেম্বার। নির্বাচনে ঝুলে থাকে চেয়ারম্যানের ভাগ্যও।মেহারন দালাল বাড়িতে বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্ম বসবাস করছে। বাড়িটিতে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাজার ও দোকানপাঠ। বাড়ির আশপাশে নেই অন্য কোনো বাড়ি। বর্ষায় ফসলি জমিগুলো পরিণত হয় বিলে। মনে হবে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বিলের মাঝখানে অবস্থিত বাড়িটি।এক বাড়িতে একসাথে বসবাস করলে তাদের মধ্যে নেই কোনো হিংসা, লোভ বা শত্রুতা। যুগের পর যুগ এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান তারা।
মেহারন দালাল বাড়ির বাসিন্দা রনজিৎ দাস, অজয়, দুলাল, রিপা দাসসহ বেশ কয়েকজন জানান, একটি বাড়িতে তাদের একত্রে থাকতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাদের মাঝে যদি কখনো কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তারা নিজেরাই তার সমাধান করেন। বাইরের কাউকে তাদের প্রয়োজন হয় না। বাড়ির যারা বয়োজ্যেষ্ঠ রয়েছেন তারাই সমাধান করেন। মাঝে মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হলেও এভাবেই একত্রে কাটাতে চান তারা।তারা দাবি করেন, বাড়ির পরিবেশ এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। কারণ বাড়িতে এখন আগের চেয়ে শিক্ষিত বেশি। অনেকেই শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। কেউ পড়ালেখা শেষ করে ব্যবসা করছেন। আবার কেউ ঢাকায় কাজ করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এই বাড়িতে যাওয়ার জন্য আগে নৌকা ছিলো একমাত্র বাহন। এখন কাজিয়ারা বাজার থেকে একটি আধাপাকা রাস্তা আছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তবে সময়ের ব্যবধানে গণবসতি নির্মাণের কারণে এখন ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।বাড়িতে গেলে দেখা যাবে বাড়িটিতে নেই হঁটার রাস্তাটুকুও। একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর। তাছাড়া কাজিয়ারা বাজার থেকে বাড়িতে আসার একমাত্র আধাপাকা রাস্তাটিরও এখন বেহাল দশা। অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। তাই নাগরিক সুবিধা পেতে দ্রুত আধাপাকা প্রধান সড়কটি সংস্কারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তাদের অসুস্থ রোগীদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে অনেক বেগ পেতে হয় তাদের। তার ওপর প্রধান সড়কটি বেহাল। এতে জরুরি প্রয়োজনের সময় কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না বলে জানান তারা। অনেক সময় রাতে অসুস্থ রোগী বা গর্ভবর্তী মায়েদের হাসপাতালে নিতে তাদের সমস্যা হয়।বাড়িটির ঐতিহ্য ও সমস্যার বিষয়ে আলাপকালে মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মবিন সুজন বলেন, মেহারন দালাল বাড়ির নিজস্ব একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এ বাড়ির ধর্মীয় উৎসবগুলো শুধু আমাদের উপজেলা নয় পুরো জেলায় প্রসিদ্ধ। অতীতে এই বাড়িতে জমিদারেরা বসবাস করতো। তারা এতগুলো মানুষ একত্রে এক বাড়িতে বসবাস করলেও তাদের মাঝে কখনো মারামারি বা ঝগড়ার খবর আমরা পাইনি। এছাড়া বাংলাদেশে এত বড় বাড়ি আছে বলে আমার মনে হয় না।বাড়িটির নামকরণ ইতিহাস সম্পর্কে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা তেমন কিছু জানেন না। শুধু জানেন একসময় এখানে জমিদার বংশের লোক বসবাস করত। তাদের আশ্রয়ে সৃষ্টি হয় এই বাড়ি। জমিদারদের দোতলা দুটি ভবন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটিতে। একটি ভবনের নাম দ্বারকাপুরি ও অপরটির নাম আম্বিকা ভবন। ভবনগুলো যথাক্রমে নির্মাণ করা হয় ১৩৩৫ ও ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে। তথ্য ছবি সংগৃহীত।
Leave a Reply